‘নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ছে অস্বীকার করার উপায় নেই’

নীরবে নিভৃতে থেকে যারা ফুটবলের কল্যাণে কাজ করেন বিশেষ করে এমন নারী ক্রীড়া সংগঠকের সংখ্যা দেশে খুব কমই রয়েছেন। যারা খেলাধুলার স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে চলেছেন, ফুটবলের উন্নয়নে অবদান রাখছেন অথচ তারা কখনই সামনে আসেন না কিংবা আসতে চান না তাদেরই একজন তাসমিয়া নাইম বিন্তি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের [বাফুফে] আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে যখন তিনি বিক্রমপুর কিংসের কাউন্সিলর হয়ে আসলেন তখনই পত্র-পত্রিকায় তো বটেই এমন কি নেট দুনিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল হলেন। হঠাৎ করেই ফুটবল আঙিনায় হৈ চৈ ফেলে দিলেন ‘বিন্তি’। কিন্তু কে এই ‘বিন্তি’ কি-ই-বা তার পরিচয়- এ নিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা ‘বিন্তি’কে খুঁজতে গিয়ে দেখেন তিনি বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাইম সোহাগের স্ত্রী। তারমানে তিনি যে ফুটবলে নতুন নন কিংবা উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন তা নয়। এতোদিন নীরবে নিভৃতে কাজ করেছেন এখন প্রকাশ্যে এসেছেন এই আর কি! আসন্ন নির্বাচন, ভবিষৎ পরিকল্পনা ও ফুটবলের নানান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল বিষয়ক নিউজ পোর্টাল ‘ফুটবল বাংলাদেশ ডটকম’কে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন তাসমিয়া নাইম বিন্তি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফুটবলবাংলাদেশ.কম এর নির্বাহী সম্পাদক মোরসালিন আহমেদ

প্রশ্ন: দেশে এমনিতেই নারী ক্রীড়া সংগঠকদের অভাব প্রকট। ফুটবলে আরো বেশি। তো কিভাবে ফুটবলে সম্পৃক্ত হলেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা করতাম। খেলাধুলার প্রতি আমার অন্যরকম একটা টান ছিল। সেই থেকে ফুটবলের প্রতি মোহ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বিশ্বজুড়েই এ খেলাটির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। এটি আমাদের প্রাণের খেলাও বটে। তাই ফুটবলের জন্য কিছু করতে পারার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। তাই দেশের ফুটবল উন্নয়নে যদি অবদান রাখতে পারি, কিছু একটা করতে পারি, নিজের কাছেও ভাল লাগবে- সেই ভাবনা, লক্ষ্য আর চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই ফুটবলের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি।

প্রশ্ন: অন্যসব খেলাধুলা থাকতে ফুটবলকেই কেনো বেছে নিলেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারীদের জন্য কিছু করা বিশেষত সেটা যদি খেলাধুলা বা ফুটবল হয় তাহলে একজন নারী হিসেবে আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি বিষয়টা কতটা কঠিন। সেই কঠিন কাজটিই আমি করতে চেয়েছি। ফুটবল হচ্ছে একটা সার্বজনীন খেলা। যা আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকে আকৃষ্ট করে। এমন কি ফুটবল যে কারোর জন্য নির্দ্বিধায় প্রথম পছন্দ। তাই ভাল লাগা, ভালবাসার জায়গা থেকে ফুটবলকেই বেছে নিয়েছি।

সহধর্মিনী তাসমিয়া নাইম বিন্তির সঙ্গে মো. আবু নাইম সোহাগ

প্রশ্ন: আর কয়েক দিন পরে তো বাফুফে নির্বাচন- এ নিয়ে কিছু ভেবেছেন কি?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নির্বাচিত হয়ে ফুটবল বোর্ডে গিয়ে কাজ করা ছাড়াও ফুটবলে অবদান রাখা সম্ভব। যেটি আমি বেশ কয়েক বছর ধরে করে আসছি। তবে কাউন্সিলর হওয়ার পর অনেকে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে পরোক্ষভাবে কাজ করার পক্ষপাতী।

প্রশ্ন: কিন্তু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে আপনি নির্বাচন করতে যাচ্ছেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: সত্যি বলতে আমি নির্বাচনের জন্য মোটেই ইচ্ছুক নই। সবসময় পেছন থেকে অবদানে আমি বিশ্বাসী। আড়ালে থেকে কাজ করার মজাই আলাদা। সেটা আমি করেও যাচ্ছি। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই সবার প্রত্যাশা বাড়ছে। নির্বাচনের জন্য ক্লাব ও তৃণমূল সংগঠকদের পক্ষ হতে আমার উপর চাপ রয়েছে- সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।

প্রশ্ন: ধরুন নির্বাচন করলেন জিতেও গেলেন তখন কোন বিষয়টি প্রাধান্য দেবেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: সুযোগ পেলে তৃণমূলের পুরুষ ও নারী ফুটবলের জন্য কিছু করাটা হবে আমার প্রধান লক্ষ্য। আমি প্রতিভা অন্বেষণের মাধ্যমে ভাল খেলোয়াড় তৈরিতে বিশ্বাসী। তাই দেশের আনাচে কানাচে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিভাবান খেলোয়াড় অন্বেষণে বিশেষভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক। আমাদের দেশে অনেক সাবিনা, সানজিদা, আখি, মারিয়া মান্ডা, ঋতুপর্ণা রয়েছে যাদেরকে খুঁজে বের করাটাই হবে আমার প্রধান কাজ।

প্রশ্ন: একজন সংগঠক হিসেবে কখনো কি ভেবে দেখেছেন কেনো ফুটবলে এগোতে পারছি না?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: আমাদের মতো দেশে কোনো কাজ করতে গেলে বাধা অনেক। অর্থের অভাব, বাসস্থানের অভাব, মাঠের অভাব, সামাজিক প্রতিকূলতা, মানসম্মত প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকা, খেলাকে পেশা হিসেবে চিন্তা করতে না পারা- এমন অনেক নাই নাই এর মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। বিশেষভাবে বৈশ্বিক মানদন্ডে এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা এবং অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ফুটবল যোজন যোজন দূরত্বে পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণেই মূলত আমাদের ফুটবল কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি বলে আমার বিশ্বাস। তাই বলে হতোদ্যম হলে চলবে না। প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সফল হওয়াই একজন সংগঠকের প্রকৃত কাজ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে খেলা চলাকালীন সময় ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ও ফিফার সেক্রেটারি জেনারেল ম্যাটিয়াস গ্রাফস্ট্রোম এর সঙ্গে বাফুফে কাউন্সিলর তাসমিয়া নাইম বিন্তি ও বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাইম সোহাগ

প্রশ্ন: তাহলে কখনো কি মাঠে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যদি তাই হয় তবে দেশী আর বিদেশী খেলার মধ্যে কি কি পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: দেখুন, আমি কিন্তু ফুটবলের মানুষ। ফুটবল নিয়েই কাজ করি। আমি একটি ক্লাবের সঙ্গেও সরাসরি সম্পৃক্ত। কাজেই মাঠে এসে খেলা দেখব না- এ কেমন প্রশ্ন করলেন! আমার হাসবেন্ড বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। দেশে তো বটেই, এমনকি বিদেশের মাটিতেও জাতীয় দলের খেলা উনার সঙ্গে মাঠে বসে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে কাঠমান্ডুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। এ দুটো দেশের ফুটবল আয়োজন এবং মাঠে দর্শক উপস্থিতি, সার্বিক আয়োজন, আতিথেয়তা বাস্তবিক অর্থেই প্রশংসনীয়। মাঠের দর্শকের উপস্থিতি যেকোনো দলকেই উৎসাহী করে এটা আমি বিশেষভাবে বলতে চাই। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আঞ্চলিক সুযোগ সুবিধা এবং উন্নত মানের স্টেডিয়াম, ইনড্রাস্ট্রাকচার যে কোনো দলকে শ্রেষ্ঠ খেলা উপহার দিতে বাধ্য করে।

প্রশ্ন: আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর হিসেবে নেট দুনিয়ায় আপনার নাম ভাসছে। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: আমি আবারো বলছি আমি কাজে বিশ্বাসী, প্রচারে নই। সত্যি বলতে অনেকটাই বিব্রত লাগছে। তবে হঠাৎ করেই ভাল করার একটা আলাদা তাগিদ অনুভব করছি।

প্রশ্ন: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে ফিরতে চাচ্ছি। আচ্ছা, দেশে ও বিদেশে আপনার প্রিয় দল কোনটি?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: দেশে নারী ফুটবল দল। দেশের বাইরে লাতিন আমেরিকান ফুটবল এবং ক্লাব ফুটবলে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল ভাল লাগে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট এর সঙ্গে তাসমিয়া নাইম বিন্তি

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় দল কোনটি সেটা না হয় জানলাম, কিন্তু বিশ্বফুটবলে আপনি কোন দেশের সার্পোর্টার?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: সরাসরি কোনো দেশের নাম বলবো না। তবে আবারও বলছি. লাতিন আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান ফুটবল সবসময়ই উপভোগ্য।

প্রশ্ন: পরপর দুটি প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন। যা হোক, ফুটবলে অ্যাটাকিং নাকি ডিফেনসিভ কোনটা ভাল লাগে?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: ফুটবল গতির খেলা, গোলের খেলা। বেশি গতি এবং গোল ফুটবল খেলার মূল আকর্ষণ। সে হিসেবে অ্যাটাকিং ফুটবলই আমার মূল আকর্ষণ। তবে অবস্থাদৃষ্টে রক্ষণাত্বক খেলারও অনেক সময় প্রয়োজন আছে।

প্রশ্ন: দেশে ও বিদেশে আপনার প্রিয় তারকা কে জানাবেন কি?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: দেশে মনিকা চাকমা, আঁখি খাতুন; বলতে গেলে জাতীয় দলের সবার খেলাই ভাল লাগে। তবে খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু কাজী সালাউদ্দিনের কথা বইতে পড়েছি। বিদেশে ব্রাজিলের মার্তা এবং ইউএসএ-এর মিয়া হাম।

প্রশ্ন: ফুটবলের বাইরে আপনার অন্য প্রিয় খেলা কোনটি?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: ফুটবলের বাইরে এখন ফুটবলই আমার প্রিয় খেলা। সাঁতার এবং ভলিবলের প্রতি বরাবরই আলাদা একটা ঝোঁক রয়েছে।

এশিয়ান অলিম্পিক কাউন্সিল এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মো. আবু নাইম সোহাগ ও তাসমিয়া নাইম বিন্তি

প্রশ্ন: এতো এতো খেলা থাকতে ভলিবলের প্রসঙ্গ টানলেন যে, এর রহস্যটাই কি?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: দেখুন, আমি কিন্তু একসময় ভলিবল খেলোয়াড় ছিলাম। কলেজপর্যায় ভলিবল দলের সদস্য ছিলাম। এমনকি, আন্তকলেজ প্রতিযোগিতায় আমাদের দল রানার্সআপ হয়েছিল। তাই ফুটবলের পর হ্যান্ডবল আমার কাছে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে।

প্রশ্ন: আসন্ন নির্বাচনে না দাঁড়ালে কোন প্যানেলকে সাপোর্ট দেবেন বলে ভাবছেন?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: কাউন্সিলরদের রায়ে যারাই নির্বাচিত হোক না কেন- তাদের জন্য আগাম শুভকামনা থাকলো।

নেপালের কাঠমান্ডুতে ২০২২ সালে সাফ নারী ফুটবলে শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ দলের উচ্ছ্বাস

প্রশ্ন: একজন সংগঠক হিসেবে ফুটবলটাকে কোথায় দেখতে চান?
তাসমিয়া নাইম বিন্তি: সত্যি কথা বলতে মাঠভর্তি দর্শকের উপস্থিতিতে খেলা আয়োজনের অনুভূতি আমার মূল আকর্ষণ। দর্শকরাই খেলার প্রাণ। প্রাপ্তি হিসেবে এশিয়ান মঞ্চের উপরের সারিতে বাংলাদেশের যাওয়া সম্ভব, সেটা দেখতে চাই, সেটা পারলে অনেক খুশি হবো।

Rent for add

সর্বশেষ নিউজ

for rent