‘আমার জীবনের সেরা অর্জন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলা’

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের শুরু থেকেই বলতে গেলে জড়িয়ে আছে তার নাম। এখনও সেই ইতিহাসকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কাজী সালাউদ্দিন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি খেলেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলেও। যে কারণে কাজী সালাউদ্দিন মনে করেন, ফুটবল তার রক্তে মিশে আছে, ফুটবল তার জীবনেরই অংশ।

সবাই জানে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে খেলেছেন কাজী সালাউদ্দিন। ছিলেন দলের কনিষ্টতম সদস্য। কিন্তু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলতে যাওয়ার আগে তিনি দু’দিন ভারতের জেলে ছিলেন- এ তথ্য ক’জন জানেন? বাংলাদেশের ফুটবল বিষয়ক প্রথম নিউজপোর্টাল ‘ফুটবল বাংলাদেশ.কম’-এর সাথে সাক্ষাৎকারে কাজী সালাউদ্দিন তুলে ধরেছেন এই অজানা বিষয়টিও।

আজ থাকছে সাক্ষাৎকারের চতুর্থ ও শেষ পর্ব। আগের সাক্ষাৎকারগুলো পড়ুন…

(পর্ব-১) : ‘২০০ কোটি টাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব’

(পর্ব-২) : ‘আমি এই কোচকে নিয়ে সন্তুষ্ট নই’

(পর্ব- ৩) : ‘বসুন্ধরার মতো আরো করপোরেট দল চাই’

পবিত্র কুন্ডু: বাফুফেতে আপনার মেয়াদ ১৩ বছরে পড়ল। আর আপনি যেমন বলেন যে শুধু সমালোচনা ও গালাগালি শুনে যাচ্ছেন। আপনার খারাপ লাগে না? কখনও মনে হয়নি ছেড়ে দিই বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিই!

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, অবশ্যই খারাপ লেগেছে। একটা প্রফেশনাল গ্রুপ আছে, যারা কথায় কথায় এমন করে। আর ফেসবুকটা তো এমন… বেকার লোকের কাজ। আমাকে খোঁচা দিলে কিছু লোক তো ঘুরে তাকায়। তবে কোনোরকম প্রতিবাদ আমি করিনি। মাঝেমাঝে আপনাদের মাধ্যমে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আরেকটি জিনিস কি খারাপ তো লাগেই। কিন্তু আমি যখন বাফুফের দিকে তাকাই, ফুটবলের দিকে তাকাই, আমি এটাকে ছাড়ি না। কারণ কী বলি। ফুটবল আমার রক্তে। এটা আমার জীবনের অংশ।

পবিত্র: তার মানে ফুটবল আপনার কাছে একটা মিশন?

সালাউদ্দিন: অবশ্যই। ফুটবল আমার কাছে একটা মিশন যে এটা নিয়ে কিছু করে যাব। আমি কিন্তু অবৈতনিক প্রেসিডেন্ট। শতকরা ৯৮ ভাগ জাতীয় ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পেইড। ফিফা, এএফসির প্রেসিডেন্ট পেইড। কিন্তু বাফুফের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বেতন নিই না, সাফের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও বেতন নিই না।

না হলে ৭১-এ দেখেন আমার চাচাত ভাই-টাই যখন লন্ডনে-ইউএসএতে পড়তে চলে গেল, আমারও যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি গেলাম ‘যুদ্ধে’। আমার বয়স তখন সাড়ে ১৬ বছর। আমি টেলিভিশন বা মিডিয়ায় এরকম গালাগালি শুনে একবার এক আইনজীবীর কাছে গিয়ে বললাম কী করতে পারি। তিনি বললেন, অবশ্যই মামলা করতে পারেন। এসব এরা করতে পারে না উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত।

পরের দিন বাসায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে এ নিয়ে কথা বললাম। আমার মেয়ে সারাজিন বলল, আব্বু আমি জানি তুমি মামলা করে সবাইকেই টানতে পারবা। কিন্তু আমি বলি কি এটা করো না। কারণ এটা করলে কিছু বাজে মানুষকে বক্সিং রিংয়ে টেনে আনবা। তুমি ১০টা বক্সিং করলে, তারা তোমাকে একটা অন্তত মারবে। ওরা আগাছার অংশ, আগাছাতেই মিশে যাবে। তখন আমি রিয়ালাইজ করলাম, হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। আমি মামলার দিকে আর যাইনি।

পবিত্র: আপনার ‘যুদ্ধে’ যাওয়া মানে তো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দেওয়া? রণাঙ্গনে তো যুদ্ধ করেননি।

সালাউদ্দিন: যুদ্ধের মতো করেই আমাকে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলতে যেতে হয়েছে। আমি বর্ডারে ছিলাম ১২ দিন। ভারতে জেলে ছিলাম ২ দিন। আমরা যখন ত্রিপুরার (আগরতলা) বর্ডার ক্রস করি, একটা ফলস আইডি কার্ড বানিয়ে নিয়ে যাই। বিএসএফ আর আর্মি চেক পোস্ট ছিল অনেক। আমার সঙ্গী চিফ জাস্টিস বিএ সিদ্দিকীর ছেলে বন্ধু হেমায়েত আহমেদ সিদ্দিকী (করোনায় মারা গেছেন ১৫-২০ দিন আগে)।

তো আমার আর হেমায়েতের কাছে ওই আইডি কার্ড পেয়ে আমাদের জেলে পুরে দিল। অনেক লোক থাকায় এই জেল বানানো হয় লোহার রডের ওপর বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করে। দুইদিন পর একটা জিপ এল। জিপ থেকে বাংলায় কথা ভেসে আসছে। আমি কাছে গিয়ে দেখি মাখন ভাই, ছাত্রলীগ নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন। আমি ডাকতে থাকি, মাখন ভাই, মাখন ভাই…। মাখন ভাই আমাকে বলেন, অ্যাই তুমি এখানে কী করো? আমি বললাম, আমারে তো ঢুকায় দিছে, শিগগির বের করেন। মাখন ভাই আর্মি ও বিএসএফের কাছে বলে-কয়ে আমাকে ও হেমায়েতকে মুক্ত করেন।

পবিত্র: এটা তো আপনার জীবনের স্মরণীয়তম অধ্যায়।

সালাউদ্দিন: আমি খুব সৌভাগ্যবান যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশ হতে পেরেছি। তার স্নেহ পেয়েছি। আর কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অফিসে বসে আমার বন্ধু শেখ কামালের সঙ্গে চা-বিস্কুট খেতে পেরেছি। পরে তার সঙ্গ পেয়েই নতুন একটি দেশের ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পেরেছি। আমার জীবনের সেরা অর্জন বা সাফল্য যা-ই বলেন এটাই।

পবিত্র: স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তো অনন্য এক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা দেখা যায়নি যে স্বাধীনতার জন্য ফুটবলাররা বিদেশের মাটিতে ফুটবল খেলে বিশ্ব জনমত গঠন করেছে। খুবই গৌরবের ব্যাপার। অথচ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। আপনি চান না যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল স্বীকৃতি পাক?

সালাউদ্দিন: অবশ্যই চাই। কিন্তু আমি এটা নিয়ে কোনো মুভমেন্টে যাইনি, যাবও না। কারণ আমি দলটির অংশ ছিলাম। তবে আমি জানি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বর্তমান সরকার বা শেখ হাসিনা সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে এসেছে, পায়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের যে কেউ অসুখ-বিসুখের সময় চাইলেই প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য পেয়েছেন, ২০-৩০ লাখ টাকা করে পেয়েছেন। তসলিম পেয়েছেন। লুৎফর ৩০ লাখ টাকা পেয়েছেন। আরো অনেকে পেয়েছেন।

পবিত্র: আপনার কি মনে হয় যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বিশেষ দু’একজনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই এই স্বীকৃতি পেতে দেয়নি?

সালাউদ্দিন: আমি এসব নিয়ে কিছু বলতে পারব না। আমার জানাও নেই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমার কাজ ছিল ফুটবল খেলা। অন্য সবকিছু দেখেছেন সিনিয়ররা, অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুরা। ওনারা কী করতেন না করতেন আমি জানতাম না, আমার বয়স তখন সাড়ে ১৬ বছর, কেউ আমাকে পাত্তাও দিত না। আমি কিছু জানতে চাইতাম না। তারাও জানাত না। আমি নিয়ম মেনে কঠোর অনুশীলন করে গেছি যাতে বাড়ির কথা মনে না পড়ে। সবসময় চেয়েছি মাঠে ভালো পারফরম্যান্স করতে। স্বপ্ন ছিল ভালো ফুটবলার হয়ে ওঠা।

পবিত্র: আপনাকে কখনও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় হিসেবে বিশেষ সুবিধা নিতে শুনিনি। এ নিয়ে কোথাও উচ্চবাচ্যও করেননি…।

সালাউদ্দিন: আমি কখনো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় দিই না। কখনও বলি না আমি বাফুফের প্রেসিডেন্ট বা সাফের প্রেসিডেন্ট। আমি একটিমাত্র পরিচয় দিই- আমি সালাউদ্দিন, আবাহনীর সালাউদ্দিন।

পবিত্র: বাফুফের পাশাপাশি সাফেও তো ১২ বছর হয়ে গেল আপনার। সাফে কেমন কাজ করছেন?

সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, সাফেও তৃতীয় দফা নির্বাচিত আমি। ওখানে কিন্তু সব জায়ান্টরা আছেন। আগে সাফের প্রেসিডেন্ট ছিলেন অন্য দেশগুলোর সাবেক সব মন্ত্রী। যেমন ভারতের প্রফুল প্যাটেল। পাকিস্তানের হোম মিনিস্টার। আমি যখন ১২ বছর আগে দায়িত্ব নিই তখন সাফের একটিমাত্র টুর্নামেন্ট ছিল। এখন ৮-৯টি টুর্নামেন্ট। আগে সাফ ফিফা-এএফসিতে স্বীকৃত বডি ছিল না, গত চার বছরে সেটি করে দিয়েছি। আগে একশো টাকাও ছিল না তহবিলে। আর্থিক ভিত্তি দিয়েছি, ফিফা-এএফসি’র বার্ষিক বাজেটে নিয়ে গেছি। আমি স্পনসর এনেও তহবিল বাড়িয়েছি।

পবিত্র: সাফের সবচেয়ে বড় শক্তি ভারত। আপনার কি মনে হয় না ভারত সাফকে এখন তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না, নাহলে ওরা কেন অনূর্ধ্ব-২৩ দল পাঠায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে? কেন টুর্নামেন্ট পেছায় বারবার?

সালাউদ্দিন: না,না, ভারত সাফ টুর্নামেন্টকে উপেক্ষা করে না। এখন এত টুর্নামেন্ট হয়ে গেছে, পেশাদারি এত বেড়ে গেছে যে ভারতও অন্যভাবে ভাবছে। ওদের দুটি পেশাদার লিগ চলছে। ভারত যদি ফিফার উইন্ডোর সঙ্গে মিলে চলতে পারে, তখন সাফকে উপেক্ষা করতে পারে, অন্যথায় নয়। আর সেটা হবেও না। আমার সঙ্গে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট প্রফুল প্যাটেলের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক। এই তো গত বছর করোনার আগে দিল্লিতে ওনার ছেলের বিয়েতে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেলেন। বললেন, বিয়েতে আমাকে থাকতেই হবে। হোটেলে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। না, না ভারত ভালোভাবেই সাফের সঙ্গে আছে। ওরা চেষ্টা করে।

পবিত্র: আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আপনার একটা বড় শক্তির জায়গা বলে শুনি…।

সালাউদ্দিন: এই যে দেখেন কাতারে আমার টিম বারবার যায়, চার-পাঁচবার গেছে। ফাইভ স্টার হোটেলে থেকে তিন সপ্তাহ-চার সপ্তাহ টেনিং করেছে। কাতার খরচ দেয়। কাতারের সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি করতে যাচ্ছি আমার টিমের কন্ডিশনিং ক্যাম্প করার জন্য। আমি জাপানে টুর্নামেন্ট খেলানোর জন্য চায়নাতে মেয়েদের টিম পাঠালাম। ফ্রি অব কস্ট।

কোরিয়া-জাপানের সঙ্গেও আমার খুবই ভালো সম্পর্ক। আমি যখন ফিফা-এএফসির মিটিংয়ে যাই, হোটেলে চেক ইন করলেই জাপানের প্রেসিডেন্ট মেসেজ রাখে- কাজী আই অ্যাম হিয়ার। কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট রিসেপশনে আমার জন্য তার রুম নম্বর রেখে যায়। এমন সম্পর্ক অবশ্যই কাজে লাগে।

পবিত্র: আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।

সালাউদ্দিন: আপনাকেও।

Rent for add

সর্বশেষ নিউজ

for rent