স্পোর্টস ডেস্ক : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১:১৭:৫৮
বিশ্ব ফুটবলের জন্য ২০২৩ বছরটা ছিল সত্যিই ঘটনাবহুল। বছর শেষে ট্রান্সফার নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র প্রায় প্রতি বছরই তৈরী হয়। কিন্তু এবার তাতে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে সৌদি পেশাদার লিগের আকস্মিক উত্থান। হঠাৎ করেই ইউরোপীয়ান শীর্ষ ক্লাব ছেড়ে তারকারা লোভনীয় প্রস্তাবে মরুর দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যার পথ তৈরী করে দিয়েছিলেন পর্তুগীজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এরপর লিওনেল মেসিও ইউরোপ ছেড়ে ফুটবলকে উপভোগের লক্ষ্য হিসেবে মেজর লিগ সকারের ইন্টার মিয়ামিকে বেছে নেন।
পুরুষ ফুটবলে ট্রান্সফার নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনার বাইরে নারী ফুটবলেও এটি ছিল স্মরণীয় এক বছর। স্পেনের বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের ঘটনা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় দেশটির ফুটবল প্রধান লুইস রুবিয়ালেসের চুমু কান্ডে।
এছাড়া ম্যানচেস্টার সিটির প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাসহ ট্রেবল জয়, মেসির রেকর্ড অষ্টম ব্যালন ডি’অর জয়, ঘরোয়া সূচির বাইরে ফিফা ও উয়েফার ব্যস্ত আন্তর্জাতিক সূচিতে খেলোয়াড়দের মধ্যে পরিশ্রান্ত ভাব চলে আসা, ইনজুরির তালিকা দীর্ঘ হওয়া- সব মিলিয়ে ফুটবলের বেশ কিছু ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম একটি স্মরণীয় বছর হিসেবে ইতোমধ্যেই বিবেচিত হচ্ছে ২০২৩ সাল।
২০২৩ সালে বিশ্ব ফুটবলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর প্রভাব : ২০২২ সালের নতুন বছরের আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাথে চুক্তি বাতিল করার কারণে ক্লাববিহীন হয়ে পড়েছিলেন পর্তুগীজ সুপারস্টার। ব্রিটিশ সাংবাদিক পিয়ার্স মরগানের সাথে খোলামেলা এক সাক্ষাতকারে ইউনাইটেডকে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেছিলেন রোনালদো। যেখানে কোচ এরিক টেন হাগ ও ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদ নিয়েও সমালোচনা করেছিলেন পর্তুগীজ সুপারস্টার। আর এতেই তার বিদায় নিশ্চিত হয়।
ইউনাইটেড ছাড়ার পর ইউরোপীয়ান অন্যান্য ক্লাবগুলো রোনালদোর বেতনের সাথে আপোষ করতে পারেনি, যে কারণে সৌদি পেশাদার লিগে যাওয়াটা অনুমেয় ছিল। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি আল নসরে যোগ দিয়ে রোনালদো ট্রান্সফার মার্কেটে সবচেয়ে বড় সংবাদটি দেন। সৌদির ক্লাবটির সাথে মূল বেতন ৫০ মিলিয়ন ইউরোর সাথে পৃষ্ঠপোষক ও আরো অন্যান্য বোনাস মিলিয়ে আরো ২০০ মিলিয়ন ইউরো যোগ হয়।
রোনালদোর এই পথ সৌদি লিগে যোগদান গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতে যথেষ্ঠ প্রভাব পড়েছে। তার পথ ধরে একে একে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছেন নেইমার, করিম বেনজেমা, এন’গোলে কান্তে, সাদিও মানে, রুবেন নেভেস, রিয়াদ মাহরেজ, রবার্তো ফিরমিনো, অমারিক লাপোর্তে, জর্ডান হেন্ডারসনের মতো তারকারা।
লিওনেল মেসির জন্য সফল একটি বছর : ২০২২ সালের ডিসেম্বরে লিওনেল মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনা ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলে। কিন্তু মেসির এই সাফল্য এখানেই থেমে থাকেনি। যদিও ২০২৩ সালের শুরুটা কিছুটা খারাপ হয়েছিল। সমর্থকদের তোপের মুখে লিগ ওয়ানের শেষ ম্যাচ শেষে হতাশা নিয়েই পিএসজি থেকে বিদায় নিয়েছেন মেসি। এরপর তিনি ডেভিড বেকহ্যামের ক্লাব ইন্টার মিয়ামিতে নাম লেখান। মিয়ামিতে গিয়েই বেকহ্যামের দলকে লিগ কাপের শিরোপা উপহার দিয়েছেন। বিশ্বকাপের সাফল্যে রেকর্ড অষ্টমবারের মতো ব্যালন ডি’অর ট্রফি জয় করেছেন। ইন্টার মিয়ামিতে তার সাথে আরো যোগ দিয়েছেন বার্সেলোনার সাবেক সতীর্থ জোর্দি আলবা, সার্জিও বাসকুয়েটস। এ বছর মেসি আর্জেন্টিনার বর্ষসেরা ফুটবলারের পাশাপাশি লরিয়াস বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কারও জয় করেছেন।
এইতানা বোনমাতি, নারী ফুটবলের নতুন তারকা : স্পেন ও বার্সেলোনা নারী ফুটবলে নতুন তারকা হিসেবে খুঁজে পেয়েছে এইতানা বোনমাতিকে। অ্যালেক্সিয়া পুতেলাসকে হটিয়ে নিজেকে লাইমলাইটে নিয়ে এসেছে বোনমাতি। ইনজুরি ও ফর্মহীনতার কারণে পুতেলানের বছরটা মোটেই ভাল কাটেনি। এই সুযোগ বার্সেলোনার তারকা মিডফিল্ডার বোনমাতি ২০২৩ নারী বিশ্বকাপে নিজেকে মূল তারকাতে পরিণত করেন।
বিশ্বকাপে স্পেনের প্রথম ম্যাচে কোস্টরিকার বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ের ম্যাচটিতে তিনি দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালের পথে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ৫-১ গোলের জয়ের ম্যাচটিতে বোনমাতি দুই গোল করা ছাড়াও দুটি অ্যাসিস্ট করেছেন। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল অ্যাওয়ার্ডও জয় করেন।
বার্সেলোনার হয়ে বোনমাতি প্রিমিয়ার ডিভিশন, নারী চ্যাম্পিয়ন লিগ, সুপারকোপা ডি এস্পানা শিরোপা জয় করেছেন। নারী বিভাগে ব্যালন ডি’অর ট্রফি পেয়েছেন, উয়েফা বর্ষসেরা নারী খেলোয়াড় ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয় করেছেন।
রুবিয়ালেস বিতর্কে স্পেনের বিশ্বকাপ শিরোপার আনন্দ ম্লান : যৌথভাবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে আয়োজিত নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলে পরাজিত করে স্পেন শিরোপা জয় করে। কিন্তু ম্যাচ পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্প্যানিশ ফেডারেশন প্রধান লুইস রুবিয়ালেস অনাকাঙ্খিত এক ঘটনার জন্ম দিয়ে স্প্যানিশ কৃতিত্বকে ম্লান করে দিয়েছেন। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি স্প্যানিশ খেলোয়াড় জেনি হারমোসোকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেন। এই ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ঝড় শুরু হয়। তোপের মুখে রুবিয়ালেস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফিফা তাকে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে।
ম্যানচেস্টার সিটির আধিপত্য : ইউরোপে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ম্যানচেস্টার সিটি একে একে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শিরোপা ঘরে তুলে ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। এর মাধ্যমে পেপ গার্দিওলা নিজের মিশন পরিপূর্ণ করতে সমর্থ হন। গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও এ বছর উয়েফা সুপার লিগ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয় করে ২০২৩ সালটা আরো স্মরণীয় করে রাখলো ইংলিশ চ্যাম্পিয়নরা।
সব বিভাগে সিটি প্রতিপক্ষ দলগুলোর উপর আধিপত্য দেখিয়েছে। আর এ যাত্রায় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নরওয়েজিন তরুণ তুর্কি আর্লিং হালান্ড। বর্তমান ইনজুরিতে থাকা কেভিন ডি ব্রুইনা ছিলেন দলের সাফল্যেও নেপথ্যের নায়ক। ডি ব্রুইনাকে সহযোগিতা করেছেন রডি ও বর্তমানে বার্সেলোনায় যাওয়া ইকে গুনডোগান। রক্ষণভাগে জন স্টোনস ও কাইল ওয়াকার নিজেদের প্রমাণ করেছেন। গোলবারে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে ছিলেন ব্রাজিলিয়ান নাম্বার ২ এডারসন।
ইনজুরির আশঙ্কাজনক হার : ব্যস্ত সূচিতে তরুণ খেলোয়াড়দের ইনজুরির মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের পরপরই খেলোয়াড়দের ক্লাব ফুটবলে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে মাঠে নামতে হয়েছে। যে কারণে মানসিক ও শারিরীকভাবে পরিশ্রান্ত খেলোয়াড়রা ইনজুরিতে পড়েছেন। এক সমীক্ষায় জানা গেছে বিশ্বকাপের পর ব্যস্ত সূচিতে যারা ইনজুরিতে পড়েছেন তারা প্রত্যেকেই কমপক্ষে আটদিন মাঠের বাইরে ছিলেন। বছর জুড়েই ইনজুরির মাত্রা ব্যাপকহারে লক্ষ্য করা গেছে।
প্রিমিয়ার লিগের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই লিগে সারা বছর জুড়ে ১০০রও বেশি খেলোয়াড় ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছেন। ঘরোয়া সূচির বাইরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও অন্যান্য উয়েফা প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়দের ব্যস্ত থাকতে হয়, সাথে আন্তর্জাতিক সূচিতো রয়েছেই। এ কারণে প্রতি বছরই ব্যস্ততার মাত্রা বাড়ছে। ২০২৪ সালে ইউরো ও কোপা আমেরিকার দুটি বড় আসর রয়েছে। ২০২৫ সালে রয়েছে বর্ধিত কলেবরে নতুন ফর্মেটের ক্লাব বিশ্বকাপ। তার পরের বছর অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ।
তরুণ খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে ইনজুরির মাত্রা একটু প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। রিয়াল মাদ্রিদের ২২ বছর বয়সী ভিনিসিয়াস জুনিয়র ইতোমধ্যেই ক্লাব ও দেশের হয়ে ১৮ হাজার ৮৭৬ মিনিট খেলে ফেলেছেন। এই একই বয়সে সাবেক তারকা রোনলদিনহোর তুলনায় যা প্রায় দ্বিগুণ। ২৪ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পে একই বয়সে থিয়েরি অঁরির তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি খেলেছেন।বাসস
Rent for add